** সলিলসমাধি ** - সুদীপ তন্তুবায় নীল হেমন্তের শিশিরস্নাত আলের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বিনয় যখন তাল পলাশের বাগানে বেলা তখন প্রায় আসন্ন । নেশাখোর সূর্যিটা ঢলে গেছে নীড়ে ফেরা বলাকার দল দু একটা শঙ্খচিল । একটু পরেই ইতিকা বেলার মায়া কাটিয়ে নামবে সাঁজালের ধোঁয়া । বিনয় তাড়াতাড়ি পা চালায় সন্ধ্যার আগেই বাউরী পাড়ায় পৌছুঁতে হবে । মথুরের বাড়িতে আজ নবান্ন । নতুন ধান ঘরে উঠেছে তাই নতুন চালের অন্ন গ্রহনের নেমতন্ন বিনয়ের । সেই সুবাদে পাশের বাড়িতে ভালোবাসার মুখখানি দর্শিবার অতৃপ্ত কামনা তার হৃদয়ে । অবশেষে বিনয় যখন বাউরী পাড়ায় পৌছুঁল প্রদোষক্ষণের গন্ডী পেরিয়ে পুবের কোনে উঠেছে আধফালি চাঁদ । কালুদের পুকুড়পাড় ধরে বিনয় চলেছে তার গন্তব্যে । শনশনে উত্তুরে হাওয়া যেন মৃত্যুর কাঁটা বিঁধে দিল বিনয়ের শরীরে । হঠাৎ জলের শব্দ ঝপাং । যেন পুকুরের জল দুভাগ হয়ে গেল । বিনয় চমকে উঠে ফিরে তাকাতেই দেখে কে যেন জলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল । সে তাড়াহুড়ো করে ঘাটের দিকে গিয়ে ভালো করে ব্যাপারটা লক্ষ্য করার চেষ্টা করল । চাঁদের আলোয় শুধু দুটো হাত দেখতে পেল । হাতদুটোও ধীরে ধীরে সমাধিস্থ হল জলের ভিতর । অগ্রহায়নের ঠান্ডা জল উত্তুরে ঝেড়ো হাওয়া বিনয় কি করবে ভেবে না পেয়ে ঝোলাখানি নামিয়ে ধীরে ধীরে নেমে গেল কনকনে ঠান্ডা জলে । গলা পর্যন্ত জলে নেমে কম্পিত দেহে বিনয় সাঁতরে চলল ডুবন্ত ওই মানব কিবা মানবীরে বাঁচাবার লক্ষ্যে । হয়তো সে চেনা কিংবা অচেনা কিংবা আপন কেউ - কম্পিত শিরা উপশিরা ধমনীর দূষিত বিশুদ্ধ রক্ত যেন জমাট বেঁধে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে । সে চলেছে ডুবসাঁতারে তাকে খোঁজার দুরন্ত প্রয়াসে । বিনয়ের দেহ অসাঢ় হয়ে আসছে তবুও সে হার মানেনি । জলের ভিতর তার চঞ্চল অশান্ত হাতে পায়ে যেন এক অসহায় তাঁতীর প্রতিচ্ছবি তাকে সচল হাতে পায়ে যেন আজ রাতে বুনতেই হবে একটা কাপড় যন্ত্রণার যন্ত্র খোঁয়াড়ে । হঠাৎ বিনয়ের পায়ে কি যেন জড়িয়ে গেল পরক্ষণেই ডুবসাতাঁর । তুলে আনল এক মানবীর দেহ শাড়ীর আঁচল জড়িয়ে আছে বিনয়ের পায় । ধীরে ধীরে কম্পিত হাতে দেহটাকে তুলে নিয়ে এল পুকুড়ের পাড়ে । বিনয়ের যা প্রাথমিক চিকিৎসার জ্ঞান ছিল তা আজ সে কাজে লাগাতে পেরেছে । বিনয় তার হাত পা ঘষে দিতে লাগল তার দু হাত দিয়ে পেটে বুকে চাপ দিয়ে উদরস্থ জল বার করবার দুরন্ত প্রয়াসে লিপ্ত থাকল কম্পিত হাতে । বিনয় তার মুখটার দিকে চেয়ে ভালো করে চেনবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল, তার শরীর স্পর্শ করে মনে হয় যেন সে আজন্ম পরিচিত কেউ । রাত্রির শেষ প্রহরে মেয়েটার যখন জ্ঞান ফিরল সে কম্পিত কন্ঠস্বরে বলে উঠল - কে ? তু-উ-ই কে ? মেয়েটার কন্ঠস্বর শুনে বিনয় নির্বাক হয়ে গেল - এ তো সে-তার প্রেয়সী ! তার জন্ম জন্মান্তরের অতৃপ্ত ভালোবাসা । বিনয় ডুঁকরে কেঁদে বলল - দুগ্গা আমি গো তোমার বিনয় । তুমি এসব করতে এলে কেন ? বলো ? - তুই পলহায় যা রে, হামার বাবু তকে মাইরে ফেলবেক । হামাদের বালোবাসা গরের লকে মাইনে লিবেক নাই রে । হামাকে আগুনের চেঁকা দিয়েছে হাতে, দেক । জলে ডুইবে মইরতে বইলেছে তাই.... বিনয় দুগ্গার মুখে হাত দিয়ে থাক আর নয় এই বলে তার ডান হাতখানা দেখে সত্যি আগুনের ছেঁকা জল পেয়ে সাদা হয়ে গেছে হাতের চামড়া উঠে । দম বন্ধ হয়ে আসে দুগ্গার হাঁসফাঁস করতে থাকে মরণ যন্ত্রণায় । মহুলের তলে তাকে নিয়ে এসে নিজের কোলে প্রেয়সীর মাথাটা রেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে বিনয় । ঠান্ডা হয়ে আসে দুগ্গার শরীর । বিনয় তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় ধীরে ধীরে - দুগ্গা ? নির্বাক দুগ্গার চোখদুটো বুজে আসে । আবার ডাকে - দুগ্গা ? দুগ্গা সাড়া দেয় না । জরাজীর্ণ এক অন্তরে অতৃপ্ত ভালোবাসা রেখে দুগ্গা চলে যায় চিরতরে । সামনেই হেমন্তের এক নতুন ভোর । কে জানে বিনয়ের জীবনে কি আছে ! মহুলের তলে দুগ্গার নিথর দেহটা নিয়ে বিনয় বসে থাকে জীবন্ত এক লাশ হয়ে । হেমন্ত কুয়াশার সাগরে যেন এক অতৃপ্ত প্রেমের সলিলসমাধি । শেষ প্রহরের পাখিরা জেগে উঠেছে একে একে । দুগ্গার আঁচলে ঝরে পড়েছে শিশির ভেজা মহুলের পাতা একট দুইটা করে........ **(THE END)**